গদ্য: ঈশ্বরেরা নির্বাক, রাজনীতি কথা বলেলে
লেখা: সুমাইয়া তানজিম বিনতে মাসুদ
পৃথিবীটা গোল নয়, বাঁকা। ঈশ্বরের নামে এই বাঁক আরও বিষাক্ত হয়েছে। পৃথিবীর আদি যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ খুঁজে ফিরেছে আলোর পথ, সত্যের পথ, ঈশ্বরের পথ। তাই তো সৃষ্টি হয়েছে কত ধর্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি, শিখ, জৈন, বাহাই, যরোস্ত্রীয়, আফ্রিকান লোকধর্ম, আদিবাসী টোটেম বিশ্বাস, শিন্তো কিংবা নতুন যুগের নব্যধর্ম। প্রত্যেকেই ঈশ্বরকে খুঁজেছে আপন ভাষায়, আপন প্রার্থনায়। অথচ এই ঈশ্বরেরা আজ নিঃশব্দ, যেন কারাগারে বন্দি। বন্দিদশার চাবি যার হাতে, তার নাম, রাজনীতি।
ওয়াশিংটনের সাদা প্রাসাদে বসে একদল মানুষ ঠিক করে দেয় কোন ঈশ্বর পবিত্র, আর কোন ঈশ্বর শত্রু। এক গোয়েন্দা রিপোর্টে লেখা হয়, ঈশ্বরকে অস্ত্র বানাও, আর শাসন করো আত্মার ভেতর থেকে। এই মন্ত্রে বিশ্বাস করে হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে গড়ে ওঠে থিংক ট্যাঙ্ক, ধর্মীয় সংগঠন, মিশনারি গ্রুপ, উগ্র সংগঠন, গোপন উপদেষ্টা বোর্ড।তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট, মানুষকে বিভক্ত করো বিশ্বাসের নামে, তারপর একে অপরের শত্রু হিসেবে দাঁড় করাও।
পাকিস্তানের কোনো মাদ্রাসায় এক নিরপরাধ ছেলেকে বোঝানো হয় , তুমি জিহাদ করলেই জান্নাত।অন্যদিকে, ইরানের কারাগারে একজন ইহুদি তরুণকে বলা হয় , তোমার ধর্ম একমাত্র সত্য, বাকিরা বিপথগামী।ফ্রান্সে এক ক্যাথলিক চার্চে, এক যাজক গোপনে রিপোর্ট পাঠান ইউরোপিয়ান কাউন্সিলে , কোন মুসলিম পরিবারে কয়টি বাচ্চা জন্মাচ্ছে।
এতোসব ঈশ্বরের নামে, অথচ ঈশ্বররা আজ নির্বাক। তারা দেখে শুধু রক্ত, আগুন, ষড়যন্ত্র, ঘৃণা।কোন মন্দির ধ্বংস হয়, কোন মসজিদে বোমা পড়ে, কোন চার্চে আগুন লাগে , সবার পেছনে একই ছায়া, গোপন চুক্তি, গোপন সভা, গোপন সেন্সরশিপ।
এক আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট হাসতে হাসতে বলে, আমরা কাউকে মারি না, আমরা শুধু এমন ব্যবস্থা করি যেন তারা নিজেরাই একে অপরকে হত্যা করে।আরেক মুসলিম স্কলার, যিনি সিআইএ’র হয়ে দীর্ঘদিন গোপনে কাজ করেছেন, একদিন তার খোলা চিঠিতে লেখেন,
আমি কোরআনের ব্যাখ্যা বদলাতে বাধ্য হয়েছি, যাতে জঙ্গিবাদ জন্ম নেয়। আমি পাপ করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় পাপ করেছে তারা, যারা ঈশ্বরকে মার্কেটিং টুল বানিয়েছে।
নাইজেরিয়ার এক ক্ষুধার্ত গ্রামে একজন খ্রিস্টান যাজক হাতে রুটি দেন আর বলেন,,ঈশ্বর তোমাকে ভালোবাসেন, শুধু বিশ্বাস বদলাও।এই ভালোবাসা বিনিময়ে দান নয়, বরং তা এক অদৃশ্য রিক্রুটমেন্ট, যেখানে ধর্মের নামে চলে রাজনীতি, আর রাজনীতির নামে বিক্রি হয় আত্মা।
জেরুজালেম থেকে কাশ্মীর, তেহরান থেকে ঢাকা, নাইরোবি থেকে নিউইয়র্ক, সবখানে একই স্ক্রিপ্ট।
শুধু ভাষা আলাদা, পোশাক আলাদা, নাম আলাদা।
কখনো ইমাম, কখনো ফাদার, কখনো রাব্বি, তাদের কণ্ঠে বিশ্বাস, কিন্তু হৃদয়ে অনুদানখেকো সরকারের চুক্তিপত্র।
আর মিডিয়া? তারা এক নতুন ধর্ম, ‘ভয়’।
যে বেশি খুন দেখায়, সেই বেশি পবিত্র।
যে বেশি রক্ত দেখায়, সে বেশি সত্য।
ঈশ্বর হারিয়ে গেছে হেডলাইন আর ট্রেন্ডিং টপিকের ভিড়ে।
“God is Dead”, এই কথাটা ফিলোসোফাররা বলেনি, বলেছে নিউজরুমের প্রোডিউসার।
তবু, সব গল্প অন্ধকারে শেষ হয় না।এক ছোট্ট ফিলিস্তিনি মেয়ের হাতে এখনো ধরা এক ছেঁড়া তাসবীহ। সে বলে,আমার ঈশ্বর যুদ্ধ চায় না, তিনি আলো পাঠান।এক আফ্রিকান উপজাতির বয়স্কা নারী সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করেন,
যেই ঈশ্বর হোক না কেন, তিনি যেন আমার নাতিদের বাঁচিয়ে রাখেন।এক হিন্দু সাধু, এক মুসলিম আলেম, এক খ্রিস্টান পুরোহিত একসাথে বসে খাওয়ান এক অনাথ ছেলেকে।সেখানে নেই ক্যামেরা, নেই মিডিয়া, নেই কোনো এজেন্ড, শুধু আছে মানবতা।ঈশ্বরেরা আজও আছেন, আমাদের হৃদয়ের গহীনে।তবে তাদের নাম বিক্রি হয়ে গেছে পুঁজিবাজারে।তারা চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন সেই সব কষ্টে, যেখানে ধর্ম নয়, শুধু ভালোবাসাই একমাত্র সত্য।
রাজনীতি কথা বলে, ঈশ্বর চুপ থাকেন।কারণ ঈশ্বর জানেন, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ, তা ঈশ্বরের নামে অপরাধ।
উপসংহার:একদিন সব ধর্মের মানুষ একত্রে দাঁড়াবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত ধরে।তখন কেউ আর বলবে না তোমার ঈশ্বর ভুল, বরং বলবে,তোমার ঈশ্বর আমার ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব, আমরা সবাই এক পথিক, শুধুই আলোর খোঁজে।