গদ্যঃ-আব্বু, আমাদের চিরন্তন আশীর্বাদ
কবি/লেখিকাঃ-সুমাইয়া তানজিম বিনতে মাসুদ
সময় চলে যায়। কিন্তু কিছু মানুষ থেকে যান আমাদের হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বংসস্তূপে বেঁচে থাকা শেষ আলো হয়ে। আমার আব্বু ঠিক তেমনই একজন মানুষ, নিঃশব্দ এক যোদ্ধা, যে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে, আমাদের ভবিষ্যৎ রচনা করেছেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়। আব্বু ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও প্রতিষ্ঠিত এক বংশের সন্তান। শিশু অবস্থাতেই তাঁর চিবুকের রেখায় আত্মবিশ্বাস, চোখে নেতৃত্বের ছাপ। বাড়িতে ছিলো বিলাস, সম্মান, ঐতিহ্য, চাষাবাদ থেকে শুরু করে জমিদারি রক্তে ছিলো। তাঁর ছিলো স্বাধীন চিন্তা, গম্ভীর সৌম্যতা, আবার অসীম মমতাও। তিনি কখনো উচ্চস্বরে কিছু বলতেন না, তবু তাঁর উপস্থিতিতেই ঘরের বাতাস থমকে যেত।
ছোটবেলা থেকেই সবাই বলতো-এই ছেলেটি একদিন বড় কিছু হবে। আর তিনি হয়েছেনও, নিজের যোগ্যতায় ভর্তি হন ময়মনসিংহ সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান,আর সেখানে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ে, ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে সবার চোখে হয়ে উঠেছিলেন এক গর্বের নাম।তাঁর শিক্ষকরা বলতেন,এই ছেলেকে আমরা গবেষণায় দেখতে চাই, দেশ গঠনে দেখতে চাই।
কিন্তু জীবন কেবল গৌরবময় পথ নয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে আসে এমন কিছু মোড়, যেগুলো মানুষকে তার আসল রূপ দেখায়।আব্বুর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো।
একটা সময়ে, যখন তিনি চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন বিদেশেও,যখন চাইলেই বিলাসবহুল জীবন বেছে নিতে পারতেন,তখন তিনি বেছে নিলেন নিজস্ব পরিবারের পাশে থেকে দায়িত্ব পালন করার পথ।
এই সিদ্ধান্ত হয়তো বাইরে থেকে ‘সাধারণ’ মনে হয়,কিন্তু এর পেছনে ছিলো অগাধ গভীরতা,ছিলো বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা, ছোট ভাই- বোনের শিক্ষার দায়িত্ব,আর ভবিষ্যতের সেই অনাগত সন্তানের জন্য একটি স্থির ও মজবুত আশ্রয় গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা।তিনি সব কিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন,
নিজের ক্যারিয়ারের উচ্চতা,খ্যাতি, অর্থ, নাম, সব। শুধু আমাদের জন্য। আমরা যারা তাঁর সন্তান, তারা জানি, কতোদিন তিনি নিজের জন্য নতুন কাপড় কেনেননি,
কতোদিন তাঁর চোখে ঘুম ছিলো না, কারণ আমাদের পরীক্ষার ফি দিতে হবে,আমাদের ছেঁড়া জুতো বদলাতে হবে,আমাদের মুখে যেন দুঃখের ছায়া না পড়ে, এটাই ছিলো তাঁর একমাত্র চিন্তা।একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি কখনো আত্মগর্বে ভাসেননি। তিনি ছিলেন মাটির মতো, শক্ত, স্থির, কিন্তু কোমল।
তাঁর হাটার ধরণ, কথা বলার ভঙ্গি, সমস্যার মুখে দাঁড়ানোর দৃঢ়তা, সবই আমাদের শিখিয়েছে সাহস কাকে বলে। আজ আমরা একটু একটু করে বেড়ে উঠেছি।আমাদের পরিচয় এখন পেশায়, শিক্ষায়, প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু আমাদের অন্তরের ঠিকানা আজও সেই মানুষটির কাছে,যিনি জীবনের সব আলো আমাদের মাঝে ঢেলে দিয়ে নিজে নীরবে পেছনে সরে দাঁড়িয়েছেন।আমরা হয়তো সবসময় প্রকাশ করতে পারিনি,কিন্তু যখন আব্বুকে দেখি, ভোরের নামাজ শেষে তিনি হাত তুলে দু’আ করছেন,
আমাদের নাম নিচ্ছেন নিঃশব্দ কণ্ঠে,তখন মনে হয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা এই নিঃস্বার্থ দোয়াটিই।আব্বুর মুখে কখনো হতাশা ছিলো না। আমরা ব্যর্থ হলেও তিনি বলতেন,যার ভিতরে সত্যতা আছে, সে একদিন ঠিকই পৌঁছে যাবে।এই বিশ্বাসটুকুই আমাদের দাঁড় করিয়েছে হাজার ঝড়েও। আজও তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন,তাঁর ডিগ্রি, অর্জন, গর্ব, সব পেছনের তাকেই রেখে দিয়েছেন।কারণ তিনি জানেন,আমরা যদি সঠিক পথে চলি, তাহলেই তাঁর জীবনের সার্থকতা।আমরা যদি কোনোদিন বড় হই, যদি মানুষ হই,তবে সেটা হবে শুধুই তাঁর প্রতিচ্ছবি হিসেবে। আব্বু, আপনি শুধু একজন মানুষ নন,
আপনি আমাদের আকাশ, আমাদের ছায়া,আপনিই সেই আলো, যে নিজের আলোয় পুড়ে গিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করেছেন। আমরা সারাজীবন আপনার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো।
15/6/2025