গল্পঃ-বাবা মায়ার ছায়া, ত্যাগের প্রতিচ্ছবি
কবি/সাহিত্যিকঃ-মোর্শেদুর কাইয়ুম মিরাজ
জীবনের প্রতিটি বাঁকে যখন ক্লান্তি এসে থমকে দাঁড়ায়, তখন এক জোড়া হাত নিরবে আমাদের পিঠে হাত রাখে-সে হাত হলো বাবার। বাবা, যার ভালোবাসা হয়ত মায়ের মতো মুখর নয়, কিন্তু তার নিরব স্নেহে গড়া প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের জীবনের ভিত গড়ে তোলে। পৃথিবীর সমস্ত লেখক থেমে যেতে পারে বাবার ভালোবাসার গভীরতা বুঝে-এ ভালোবাসা ব্যাখ্যার অতীত, অনুভবের বিষয়।
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ফাদার্স ডে-একটি বিশেষ দিন, যেখানে আমরা আমাদের বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করি, ভালোবাসার কথা বলি। তবে ভালোবাসা তো শুধু একদিনের নয়, বাবা প্রতিদিন আমাদের জীবনে অদৃশ্য ছায়ার মতো থাকেন।এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলি-একটি ছেলের চোখে দেখা এক বাবার ভালোবাসার গল্প।
গল্প: পুরোনো জুতোর শব্দ রাহুল শহরের নামী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। শহুরে জীবনে বাবার ফোন তাকে বিরক্ত করত। গ্রামে থাকা সেই বৃদ্ধ বাবা, যার কথা বলার ধরণ সাদামাটা, যিনি নতুন প্রযুক্তি বোঝেন না-সব কিছুতেই যেন রাহুল একটু অস্বস্তি বোধ করত। বাবার পুরোনো শার্ট, ছেঁড়া জুতো-সব তাকে লজ্জায় ফেলত বন্ধুদের সামনে।
একবার রাহুল অনেক অনুরোধে করে তার গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে ডেকেছিল। বাবা এলেন সেই গ্রামের পুরোনো জামা আর ফাটা সেন্ডেল পড়ে। এ দেখে বন্ধুরা হাসাহাসি করছিল। কিন্তু রাহুল তার বাবাকে অনেক ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে সেই শ্রদ্ধার জায়গা থেকে তিনি তার বন্ধুদের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।অনুষ্ঠান শেষে রাহুলের এক প্রফেসর বাবাকে বললেন, “আপনার ছেলেকে আমরা খুব সম্ভাবনাময় মনে করি। আপনি নিশ্চয়ই গর্বিত।”
বাবা একটু হাসলেন। বললেন, “ওর জন্য প্রতিদিন ১৮ কিলোমিটার হাঁটতাম, যেন ওর কোচিংয়ের টাকা বাঁচে। আমার জুতোর নিচের সোল ছিঁড়ে গেছে তাও বলিনি, কারণ ছেলেকে কখনো ছোট ভাবতে দিইনি।” রাহুলের বাবা আত্ম গর্ব নিয়ে মায়ামাখায় বললেন তুমি যখন প্রথম হাঁটলে, আমি ছিলাম ছায়া হয়ে–পেছনে পেছনে চলতাম, তুমি যখন প্রথম লিখলে নাম, আমার চোখে জল এসেছিল, ঠিক খেয়াল নাই, কিন্তু বুক কেঁপেছিল।
আজ তুমি দাঁড়িয়ে আছো নিজের পায়ে, আমার সমস্ত দিনরাত্রি যেন হেসে ওঠে এই আলো ছায়ায়।
তোমার হাসি দেখে, আমি সব কষ্ট ভুলে যাই, তুমি ভালো থাকলেই–আমার সকাল, আমার সন্ধ্যা যেন নতুন সাজে যায়।আমার সারা জীবনের প্রাপ্তি যদি একটাই হয়, তবে তা তোমার হাসিমুখ-গর্বে ভরা, শান্ত, আর মায়ায় মোড়া এক আবয়। তারপর রাহুলের বাবা রাহুলের প্রফেসর কে লক্ষ্য করে বললেন নিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনেক কষ্ট করেছি সেই কষ্ট মাখা হৃদয় নিয়ে ছেলেকে বলেছি বাবা তুই যেখানেই পড়তে চাস সেখানেই তোকে পড়াবো তাতে যত টাকা লাগে আমার কষ্ট হলেও আমি যোগাড় করে এনে দেব।
তোকে নিয়ে যে আমি অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছি বাবা সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে তোকে বড় করতে গেলে কিছু কষ্ট ক্লেশ যে আমার মেনে নিতে হবে।আমার ছেলের সফলতার দিকে চিন্তা করে আমিআমার ছেলের সফলতার দিকে চিন্তা করে আমি নিজের আরাম আয়েশ নিজের চাহিদা স্থগিত রেখেছি। আজ যদি আমার জুতা কথা বলতে পারতো তাহলে হয়তো শোনাতে পারতাম তার জন্য কত দূর দুরান্ত হেঁটেছি একটু তাকিয়েও দেখিনি জুতার অবস্থার দিকে।প্রফেসর বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আর রাহুল… সে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
সেদিন সে বাবার জুতোজোড়া হাতে তুলে নিয়েছিল। প্রথমবার অনুভব করেছিল, সেই ফাটা জুতোর শব্দে লুকিয়ে ছিল এক জীবনের সংগ্রাম, ও ভালোবাসার, আত্মত্যাগে
উপসংহার
বাবার ভালোবাসা কখনো কখনো কাঠিন্যের মুখোশে ঢাকা থাকে, কিন্তু তার অন্তরযন্ত্রে থাকে সন্তানের প্রতি অগাধ স্নেহ। বাবা কোনো একসময় আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় নির্ভরতা।এই বাবা দিবসে আসুন, আমরা শুধু একটা গিফট নয়, বাবাকে সময় দিই। তার পাশে বসি, তাঁর গল্পশুনি। বাবার হাতে নিজের হাতটা রাখি, আর মন খুলে বলি -” আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা ধন্যবাদ বাবা, তোমার মতো কেউ নেই।”
এই ভালোবাসার বন্ধনেই বদলে যেতে পারে একটি জীবন, গড়ে উঠতে পারে একটি পরিবার, আর সেই পরিবার থেকেই তৈরি হয় এক সমৃদ্ধ সমাজ।