
ছোটবেলা (গল্প)
সাইফুল ইসলাম সাঈদ
মাতৃর কোল থেকে আমরা যখন এক’পা-দু’পা করে হাঁটতে সূত্রপাত করি,তখন থেকেই আমাদের শৈশব দুষ্টুমি দিন:দিন বৃদ্ধিকরণ ঘটে।মনে ভিতর নানান ধরনের খেলায় মেতে উঠার শখ জাগে কিন্তু আকাশের পাঁচ বছর বয়সে মা পরকালগমন করার পর বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করার কারণে,সে নীরব।নির্মমতার কাতরে জীবন জড়-জড়িত। প্রায় সময় ঐদুরাকাশ পানে তাকিয়ে পাখি দেখতেন। আকাশ এভাবে চলতে:চলতে জীবনের ক্ষণ অতিক্রমে আট বছর বয়সে তাঁর চাচাজানকে বলে বাজার থেকে একটি টিয়াপাখি ক্রয়ে লালন- পালন করেন এবং সময় অতিক্রমে টিয়াপাখির বদনে মানব ভাষা ফুটে উঠে।আকাশ, শখ করে টিয়াপাখির নামকরণ করেছিলেন, ‘বন্ধু।’মাহীন ছেলে অনাদরের সহিত তাঁর বন্ধুকে নিয়েই সময়ের তালে বাড়ন্ত যুবক।হঠাৎ একদিন বন্ধু বলল, ‘আকাশ,পাশের বাড়ীর সামাদ মিয়া প্রত্যেক দিন ঘুঘুকে বন্দি খাঁচায় ধরে রাখে,ওদের ঠিকমত খেতেও দেয় না,ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে। ওরাও পাখিজাত,আমিও পাখিজাত। ওদের কষ্টে আমার কষ্ট হয়।’আকাশ বলল, ‘বন্ধু,তোমার কষ্টে আমার কষ্ট। এই কষ্ট কমাতে কি করা যায়,একটি পরামর্শ দাও।’বন্ধু বলল, ‘বদমাইশ ব্যাটার বন্দিখাঁচা থেকে ঘুঘু গুলোকে মুক্তির পথ বের করে দিতে হবে,তবেই তোমার-আমার শান্তি।’আকাশ বলল, ‘পরামর্শ ঠিক আছে,তবে সামাদ মিয়ার বশবন্দি ঘুঘুতো যাবে না,বাকি ঘুঘু গুলোকে ছেড়ে দিলেও বশবন্দি ঘুঘু দ্বারা পুনরায় ছুটন্ত ঘুঘু গুলোকে ধরে বন্দি করে নিবে। তখন উপায়?’বন্ধু বলল, ‘তাঁর মানে বলতে চাইছো…বন্দি ঘুঘু গুলোকে ছাড়ার আগে বশবন্দি ঘুঘুর শ্রবণে মন্ত্র দিয়ে সরাতে হবে?’আকাশ বলল, ‘হুম।বশবন্দি ঘুঘুর শ্রবণে মন্ত্র দিয়ে সরাতে হবে,কিন্তু তোমার কথা কি পোষা ঘুঘু শুনবে?’টিয়াপাখি উড়ে গিয়ে বশবন্দি ঘুঘু গুলোর কানে উড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এলো, অপর দিকে আকাশ ফাঁক বুঝে পোষা ঘুঘুসহ অন্যান্য ঘুঘু গুলোকে বন্দিখাঁচা থেকে মুক্তি দিলেন।ঘুঘু গুলো মুক্তি পেয়ে ঐদুরন্ত নীলাকাশের দিগন্তে ছুটন্ততায় আওয়াজ তুলে___’তুমি দিলে মোদের মুক্তি সৃষ্টিকর্তার নিকট তোমার তরে উক্তি,বুঝিয়াছে যে প্রাণের মায়া তাঁর জীবন জুড়ে
ভিতর-বাহিরে অবলোকন করিলাম রাসূলের দয়া হে সৃষ্টিকর্তা,তুমি তাঁরে করিও দয়া।’পাশের বাড়ীর সামাদ মিয়া,আকাশের পিতাকে নালিশ করার কারণে আকাশকে অনেক গুলো বেতের কষাঘাত করেন,তবু্ও তাঁর দুরন্তপনা অথামন্ত।পরের দিন রাতে কালবৈশাখী ঝড়ে অনেক গুলো বাড়ী-ঘর ভেঙে চুরমার হয়েছে।সকলে আপন:আপন পুনরায় ঘর-বাড়ী মেরামত কাজে ব্যস্ত। অপর দিকে গাছের ডালে ডালে পাখিদের বদনে কিচিরমিচির ধ্বনিতত্ব হচ্ছে।আকাশ মনে:মনে ভাবলেন যে মানুষের ঘর-বাড়ী ভেঙেছে বলে পুনরায় মেরামত করছে কিন্ত পাখির ঘর মেরামত করবে কে? পাখিতো একদিনে তাঁদের বাসা মেরামত করতে পারবে না,তাহলে পাখিরা রাতে কোথায় থাকবে? চিন্তায় অস্থিরতা বোধে বাড়ী থেকে অনক গুলো টাকা এনে কুমার বস্তি থেকে মাটির কলসি,হাঁড়ি ক্রয়ে বন্ধু সহকারে চোখ যদ্দুর যায়,ততখানি জায়গা জুড়ে গাছের ডালে ডালে কলসি, হাঁড়িতে খড়কুটো দিয়ে বেঁধে দিলেন।রাতে বাড়ী ফিরে বাবার বকনি আর বেতের কষাঘাত খেয়ে বন্ধুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।সকল বেলা। আজও আকাশে সাদা-কালো ভাসন্ত মেঘ,ক্ষণে ক্ষণে তীব্র রোদ্রময়,প্রচণ্ড গরম।
আকাশ ও টিয়াবন্ধু মিলে ক্লান্ত দুপুরে বিলে গোসল করার তাগিদে রওনা দিলেন।বৈশাখের বর্ষার যৌবনতায় বিলে শাপলা ফুল ফুটেছে। দেখতে বেশ:চমৎকার!আকাশ শাপলা ফুলের রুপে মুগ্ধ হয়ে,ফুল তুলতে গিয়ে শেকড়ে সাথে পা জড়িয়ে পরায় বিলের মাঝে আটকে গেলেন। আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগলেন। দিশা না পেয়ে বন্ধু এলাকার লোকজন ডেকে এনে আকাশকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। বিপথ থেকে মুক্তি পেলেও মনের আতঙ্ক কাটেনি।
অপর দিকে বন্ধু কড়া বিষাদ মনে অনুভব করছে যে, আমার বন্ধু আকাশ অনেক জটিলতায় রয়েছে।আমাকে যেভাবেই হোক বন্দিশালা থেকে বের হতে হবে। বুদ্ধি খাটিয়ে মরে যাওয়ার ভান করে চার হাত-পা টানা দিয়ে চুপ করে খাঁচায় লুটিয়ে পড়লেন।বিত্তশালী ব্যক্তি বন্ধুকে খাবার দিতে এসে দেখেন,টিয়াপাখিটি পরকালগমন করেছেন। খাঁচার মুখটি খুলা মাত্রই:সুযোগ বুঝে বাতাসের গতিবেগে উড়ে আকাশের বাড়ীর গাছের ডালে বসলেন।বন্ধু অনুভব করলেন,বাড়ী ভর্তি মানুষ:বিষয়টি কী?
এলাকার লোকজন কাঁধে করে যখন কবর স্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, বন্ধুও পিছু:পিছু উড়ে যাচ্ছে। কবরে নামানোর ক্ষণে আত্মীয়-স্বজন শেষ বারের মত যখন আকাশের মুখটি দেখতে লাগলেন,ঠিক ওই মুহূর্তে বন্ধু গাছের ডালে বসে দেখলেন যে,তাঁর বন্ধু আকাশ আর দুনিয়ায় নেই।
টিয়াপাখির মনে প্রশ্ন জাগ্রত, আমার বন্ধু:আমার জন্য এতোকিছু করলেন কিন্তু আমি তাঁর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমার বন্ধু আকাশ দুনিয়াতে নেই,বন্ধুহীন আমি চলতেও পারবো না।আমার এজীবন অকাজের, বন্ধুর কাছে আমাকেও যেতে হবে। আকাশের মৃত্যুতে শুধু টিয়াপাখি নয়,আরো অন্যান্য পাখিরাও দলবেঁধে গাছের ডালে ডালে কিচিরমিচির কষ্টের আওয়াজ তুলেছিলেন। মাটি দিয়ে লোকজন যখন চলে যেতে লাগলেন,তখনি টিয়াবন্ধু,আকাশের কবর মাটিতে লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে নিজের প্রাণ ত্যাগ করলেন।তাৎক্ষণিক পাখিদের কিচিরমিচির কান্নার আওয়াজ আরো বৃদ্ধি পেল।হ্যাঁরে! জীবন।