গদ্য : রক্তের উপত্যকায় বেহেশত
লেখা: সুমাইয়া তানজিম বিনতে মাসুদ
পৃথিবীর মানচিত্রে এক মহাদেশ, নাম ইউরোপ। নদীর ধারে দালান, গির্জার গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনি, ঠান্ডা বাতাসে ঝরা পাতার করুণ সংগীত, সব মিলিয়ে এক বর্ণময় চিত্র যেন। কিন্তু ইতিহাস যখন কেঁদে ওঠে, তখন এই ইউরোপকে আর দেখায় না মোহময়, তখন সে দাঁড়ায় গলায় রক্তের নীলচে দাগ নিয়ে। এক পবিত্র মুখোশের আড়ালে সে লুকিয়ে রাখে কতশত শহীদের আর্তনাদ, যারা মরেছিলো তাদের “সভ্যতার” নামে। এই ইউরোপ একদিন ঈশ্বরের নামে রক্ত ঝরিয়েছে, আবার একদিন ঈশ্বরকেই বন্দী করেছে জাদুঘরে। যখন চার্চ ছিলো সর্বশক্তিমান, মানুষ কাঁদতো ঈশ্বরের আশায়, আর যখন মানুষ ঈশ্বরকে অস্বীকার করলো, তখন তারা কাঁদলো শূন্যতার পায়ে।
এ এক অদ্ভুত মহাদেশ, যে হাত একদিন বাইবেল তুলে ধরেছিলো যুদ্ধের আগে, সে হাতই একদিন বিজ্ঞানের নামে বিশ্বাস হত্যা করেছে। একদিকে ক্যাথেড্রালের মিনার, অন্যদিকে গ্যাসচেম্বার। একদিকে দেকার্তের দর্শন, অন্যদিকে হিটলারের বিভীষিকা। তারা বলে, আমরা মানুষ, তাই স্বাধীন। তারা বলে, মানবতা ঈশ্বরের চেয়ে বড়। কিন্তু তারা জানে না, ঈশ্বর যখন হৃদয় থেকে হারিয়ে যান, তখন মানবতা কেবল এক শূন্য শব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,
যার কোনো হাত নেই, চোখ নেই, কান নেই, শুধু ঠান্ডা এক দম্ভ।
একদিন এই মহাদেশ ছিলো দাসের চিৎকারে ভরপুর, আফ্রিকার অরণ্য থেকে তারা ধরে এনেছে কালো মানুষ, যাদের হাত বেঁধে দিয়েছে, পিঠে চাবুক চালিয়েছে, আর জাহাজে তুলে দিয়ে বলেছে, তোমরা এখন আমাদের ঈশ্বরের সন্তান। কতো মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, কত কুরআন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, কতো বালিকা হয়েছে লুণ্ঠিত, আর তার পাশে বসে থেকেছে এক "পাদ্রী", যে বলেছে, ঈশ্বর ক্ষমাশীল। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হতো মানবতা, আর নিচতলায় রাখা হতো দাস। তারা নারীকে স্বাধীনতা দিলো, কিন্তু মাতৃত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে করে তুলল ভোগের এক ব্র্যান্ড। তারা শিল্প সৃষ্টি করলো,
কিন্তু শিল্পের নাম করে নগ্নতাকে করে তুলল পূজনীয়। তারা দর্শনের নামে আত্মাকে বধ করলো, আর জ্ঞানের নামে করলো বিশ্বাসের গলা কেটে ফেলা।
তারা একদিন রোমান সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলো, তাদের হাতে গড়া হয়েছিলো কলোসিয়াম, যেখানে মানুষকে পশুর সঙ্গে লড়িয়ে হত্যা করা হতো মানুষের বিনোদনের জন্য। তারপর তারা গড়ে তুলল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, সূর্য যেখানে অস্ত যায় না, এই দম্ভ নিয়ে। তারা সূর্যের আলো নিয়ে ছুটেছিলো ,কিন্তু যার দেশে ঢুকেছে, সেখানেই নিভিয়ে দিয়েছে মশাল। ইউরোপের রাজনীতি কখনো যুদ্ধ থামাতে শেখেনি, শুধু যুদ্ধকে অন্যরকম রূপ দিয়েছে, কখনো অস্ত্র দিয়ে, কখনো টাকা দিয়ে, কখনো শিক্ষা দিয়ে, কখনো সংস্কৃতি দিয়ে।
তারা বলেছে, তোমাদের ভাষা ভুল, তোমাদের সংস্কৃতি পশ্চাদপদ,তোমাদের বিশ্বাস অন্ধ। আর এইসব বলে, তারা আমাদের চোখের আলোও কেড়ে নিয়েছে। ইউরোপ জানে, কীভাবে হত্যা করতে হয় একটি জাতিকে, না গুলি দিয়ে, না ক্ষুধা দিয়ে, বরং আত্মার গভীর থেকে লজ্জা ঢেলে দিয়ে। তারা এক এক করে নিভিয়েছে আলজেরিয়ার শিশুর চোখ, তারা প্যারিসের রাস্তায় রক্তে লিখেছে "গণতন্ত্র"।
তারা আজও আফগানিস্তানে বোমা ফেলতে ফেলতে মানবাধিকারের কথা বলে, তারা সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ইউনিসেফের পতাকা উড়ায়, তারা ইরাকের গ্রামে শিশুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার তোলে। এই ইউরোপ আজও বিশ্বজুড়ে নীতি শেখায়,
কিন্তু নিজেই ভুলে গেছে, নৈতিকতা কোনো বিলাস নয়, এক আত্মজিজ্ঞাসা। তারা আজও “ইউরোপীয় মূল্যবোধ” রপ্তানি করে, যেখানে ঈমান নেই, আত্মা নেই, কেবল অর্থ আর প্রযুক্তির দম্ভ।
তবু, তবু সেই ইউরোপের ভেতরেই কোনো এক বৃদ্ধা হয়তো আজও ঘরের এক কোণে বসে চোখ বন্ধ করে দোয়া করে,
যার মুখে নাম নেই, ধর্ম নেই, কিন্তু কান্না আছে। হয়তো কোনো এক পুরনো গির্জায় ধুলো জমে যাওয়া বাইবেলের পাশে পড়ে আছে কোন অশ্রুভেজা কাগজ,যেখানে লেখা, আমরা ঈশ্বরকে ফেলে এসেছি, তাই আজ এই শূন্যতা।
পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ইউরোপীয় ঘ্রাণ, কখনো আতর হয়ে, কখনো বিষ। কখনো জ্ঞানের আলো, কখনো বিশ্বাসের মৃত্যু।তাদের চোখে সভ্যতা, আমাদের চোখে তা এক স্মৃতিহীনতা।তবুও, যারা সত্যের কথা বলে,যারা ঈমান হারায়নি,তারা একা একা হলেও দাঁড়ায় সেই ঝড়ের মুখে,কারণ তারা জানে,সভ্যতা কখনো অস্ত্রে গড়ে না, গড়ে হৃদয়ে।আর সেই হৃদয়ে আজও এক মসজিদ বেঁচে আছে,না ইট দিয়ে গড়া, না গম্বুজে মোড়া,বরং এক ফাটা বুকের গভীরে,যেখানে আজান হয় আত্মা দিয়ে,সিজদাহ হয় চোখের জল দিয়ে।এই গল্প ইউরোপের নয়,তোমার বিবেকের,যদি তুমি পড়ে নীরব হও, তুমি পরাজিত।যদি তুমি পড়ে জেগে ওঠো, তবে তুমি এখনো মানুষ।