গদ্য : আলোর নিচে অন্ধকার
লেখা: সুমাইয়া তানজিম বিনতে মাসুদ
পৃথিবীর মানচিত্রে এমন কোনো দেশ নেই, যেটি এই ছায়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। এমন কোনো মসজিদ, গির্জা, মন্দির, বা উপাসনালয় নেই, যার মিনারে বা প্রার্থনায় এই ছায়ারা ঢুকতে পারেনি। এমন কোনো মানুষ নেই, যার চিন্তা, বিশ্বাস কিংবা স্বপ্নকে তারা স্পর্শ করেনি।
এই গল্প সেই অদৃশ্য যুদ্ধের, যা কেবল মাটি আর অস্ত্রের নয়, এটি মন, চেতনা ও আত্মার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পেছনে রয়েছে সেই প্রাচীন শক্তি, যাদের নাম এক সময় কেউ উচ্চারণ করত না, ইলুমিনাতি। আর তাদের চাবিকাঠি ছিলো এক গোপন সংগঠনের হাতে, ফ্রিমাসনারী।
তারা নিজেদের বলে "আলোকিত"। অথচ তাদের আলোর নিচে জমে আছে এক রক্তাক্ত অন্ধকার। তারা আসলে জানেই না, তারা কী অন্ধকার সৃষ্টি করছে, নাকি তারা খুব ভালো করেই জানে, এবং তবু সেই অন্ধকার ছড়াতে চায়?
তাদের লক্ষ্য একটাই, এই পৃথিবীতে আল্লাহর নামে আলোর দীপ্তি নিভিয়ে দিয়ে নিজেদের নামের অগ্নিশিখা জ্বালানো। তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্, শিক্ষা ও প্রচারমাধ্যম।
তারা বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিয়েছে "মুক্ত চিন্তা", কিন্তু পাঠিয়েছে গোলামী। তারা প্রচারের নাম দিয়েছে "সত্য", কিন্তু ছড়িয়েছে মিথ্যা। তারা জ্ঞান দিয়েছে, অথচ আত্মা কেড়ে নিয়েছে।
তারা এমন শিক্ষক গড়ে তুলেছে, যারা ঈমান শেখায়, কিন্তু আত্মসমর্পণের পথ দেখায় না। তারা এমন ধর্মীয় বক্তা তৈরি করেছে, যারা জিহাদের কথা শুনলে কানে তুলো গুঁজে নেয়, কিন্তু জনপ্রিয় বাক্য বললে করতালি পায়।
ফ্রিমাসনারীরা ছিল এক প্রাচীন গুপ্ত দল, যারা বিশ্বাস করতো, সৃষ্টিকর্তার আসনও তারা অধিকার করতে পারে। তাদের গোপন মন্দিরে খোদাই করা হতো এমনসব প্রতীক, যেগুলোর অর্থ কেবল তারাই বুঝতো। তারা বিশ্বাস করতো, মানুষের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করলেই পুরো সভ্যতাকে বন্দী করা যায়। তারা সৃষ্টিকর্তার নামকে আড়ালে রেখে নিজেদের নাম সামনে আনতে চাইত।
এই গল্পে আছে একজন মানুষ, মুহাম্মাদ যোবায়ের, ঢাকার এক তরুণ আলেম, যিনি এক গভীর রাতে স্বপ্নে দেখেন, তিনি একটি অন্ধকার সভাকক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে একজন বৃদ্ধ মানুষ, চোখে কাঁচের ফ্রেম, চুলে রূপালী রেখা, দাঁড়িয়ে বলছে:
আমরাই ঠিক করি কে হবে তোমাদের ইমাম। আমরা ছাপাই তোমাদের ধর্মীয় বই, আমরা তৈরি করি তোমাদের জনপ্রিয় ধর্মীয় মুখগুলো। তোমরা কেবল প্রার্থনা করো, আর আমরা পৃথিবীর খেলায় বিজয়ী হই।
ঘুম ভেঙে যোবায়ের কেঁদে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন, কেবল নামাজ নয়, দরকার জাগরণ। দরকার দাওয়াত, সত্যের দিকে ডাক, সাহসিকতার।
ইতিহাসের গোপন পৃষ্ঠাগুলো বলে, ১৯৪৭ সালে যখন উপমহাদেশে মানুষ দেশভাগের উল্লাসে মেতে উঠেছিলো, তখন দূরে কোথাও এক গোপন কক্ষে কেউ লিখেছিলো,
তাদের দেশ দাও, ভূখণ্ড দাও, আমরা তাদের ঈমান কেড়ে নেব।এই সংগঠনগুলো ধর্মের নামেই ধর্মকে ধ্বংস করেছে। তারা বানিয়েছে এমন ইসলামিক বক্তা, যারা সূরা পড়ে কাঁদে কিন্তু সত্যের কথা বললে থেমে যায়। তারা গড়েছে এমন হিন্দু পুরোহিত, যারা নিজেদের দেবতার কাহিনি ব্যঙ্গ করে। তারা সৃষ্টি করেছে এমন যাজক, যারা মঠে বসে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
তাদের কৌশল হলো, ধর্মগ্রন্থ পরিবর্তন না করে বরং ব্যাখ্যা বদলে দেওয়া। একই বই, কিন্তু অর্থে বিভ্রান্তি। একই শব্দ, কিন্তু ভিন্ন ব্যাখ্যা।এই গল্পে আরেকজন মানুষ আছেন, আমান উল হক, এক নির্জন মাদ্রাসায় বেড়ে ওঠা হাফেজ, যিনি নিঃশব্দে গড়ে তুলেছেন একটি সংগঠন, যার কাজ, যারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে, তাদের ফিরিয়ে আনা। তিনি বলেন, এই যুগের যুদ্ধ অস্ত্রের নয়, চেতনার, সাহসের, বিশ্বাসের।
একদিন এক অদৃশ্য সভায় বলা হয়েছিলো,আমরা যদি মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে তাদের ভূখণ্ড দখল করতে হবে না। এমন এক সময় আসছে, যখন সত্য বলা হবে অপরাধ। যখন সিজদার মানুষও কেবল বাহ্যিক পোষাকে সিজদাহ করবে, হৃদয়ে নয়। এমন সময়ে যারা চুপ থাকবে, তারাই আসল পরাজিত।
কিন্তু—
এক গভীর রাতের শেষে, এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মুহাম্মাদ যোবায়ের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন: হে আল্লাহ, ওরা আমার মুখ বন্ধ করতে চায়, কিন্তু তুমিই তো হৃদয়ের কান্না শুনো। আমি একা, আমি ক্ষুদ্র, কিন্তু আমি থামবো না। কারণ আমি জানি, তোমার একজন উম্মত, যদি তার ঈমান জাগ্রত থাকে, তবে সে একাই এক লক্ষের বিপরীতে দাঁড়াতে পারে।
এই পৃথিবীর একটি গোপন মসজিদ আজও জীবিত আছে, মানুষের হৃদয়। সেখানে নামাজ হয় চোখের জলে, সেখানে খুতবা হয় আত্মার ব্যথায়, সেখানে আযান দেয় সাহসের কণ্ঠ,আর মিনারে উড়ে না কোনো পতাকা, শুধু বাতাসে ভেসে থাকে এক নাম
আল্লাহ.....!
উপসংহার:
এ গল্প ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতের সতর্কতা। এ গল্প ষড়যন্ত্র নয়, আত্মার হুঁশিয়ারি। এ গল্প ধর্মীয় নয়, চেতনার ধাক্কা।যদি তুমি পড়ে কাঁদো, তবে তুমি এখনো জেগে আছো।যদি পড়ে চুপ করে থাকো, তবে তুমি হেরে গেছো।